আল্প্ আর্সলান
আল্প্ আর্সলান (তুর্কি ভাষায় সম্মানিত বীর বা মহান সিংহ ) আরবি উপাধি : দিয়া আদ -দুনিয়া ওয়া -আদ দন আদুদ আদ-দৌলা আবু সূজা মুহাম্মদ আল্প্ আর্সালান ইবনে দাউদ জন্ম ২০ জানুযারী ১০২৯ মৃত্যু ১৫ ডিসেম্বর ১০৭২ আসল নাম মুহাম্মদ বিন দাউদ ছাগরী ছিলেন সেলজুক সম্রাজ্যের দ্বিতীয় সুলতান এবং সেলজুকের প্রপোত্র রাজবংশের সনামধন্য প্রতিষ্ঠাতা। তিনি সেলজুক অঞ্চলকে ব্যাপক ভাবে প্রসারিত করেন এবং তার ক্ষমতা বৃদ্ধি করেন ,দক্ষিণ ও উত্তর পশিমে পতিদ্বন্দীদের পরাজিত করেন এবং ১০৭১ সালে মানজিকার্টের যুদ্ধে বাইজান্টাইনদের বিরুদ্ধে তার বিজয় আনাতোলিয়ার তুর্কম্যান বন্দোবস্তের সূচনা করেন। তার সামরিক ও যুদ্ধের দক্ষতার জন্য আল্প্ আর্সালান নামটি অর্জন করেন যার অর্থ তুর্কি ভাষায় বীর সিংহ।পরিবার
আল্প্ আর্সালান ছিলেন চাগিরি বেগের ছেলে এবং সেলজুক সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান তুঘ্রিল এর ভাতিজা। তার দাদা ছিলেন মিকাইল যিনি পালাক্রমে যুদ্ধবাজ সেলজুকের পুত্র ছিলেন। তিনি মেলিক শাহ প্রথম ও তুতুস প্রথম সহ অসংখ সন্তানের পিত ছিলেন। এটা স্পষ্ট নয় যে তার সন্তানের মা বা মায়েরা কে বা কারা ছিলেন। তিনি দুই বার বিয়ে করেছেন বলে জানা গেসে। তার স্ত্রীদের মধ্যে ছিল তার চাচা তুঘরিলের বিধবা আঁকা খাতুন নামে পরিচিত কারা খানিদ রাজকন্যা এবং জর্জিয়ার চতুর্থ বগরাতের মেয়ে বা ভাতিজা। সেলজুকের অন্য পুত্রদের মধ্যে একজন ছিলেন তুর্কি সর্দার আর্সালান ইসরায়েল যার পুত্র কুলতামিস তার ভাতিজার উত্তরাধিকর সূত্রে সুলতানের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। আল্প্ আর্সালান এর ছোট ভাই সুলাইমান ইবনে ছাগরী এবং কোৰ্ভূত ছিলেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী। সুলাইমান ইবনে কুতালমিশের পুত্র ও উত্তরাধিকারী কিলিজ আর্সালান (কুলতামিসের পুত্র যিনি পরে রামের সুলতান হয়ে উঠবেন ) প্রথম কুরুশেড এবং ১১০১ সালে কুরুশেড এর সময় ফ্রাঙ্খাদের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিলেন।
প্রাথমিক জীবন
তোপকাপি প্যালেস মিউজিয়ামে অবস্থিত আল্প আর্সালানকে চিত্রিত করে একটি ক্ষুদ্রাকৃতি।
আল্প আর্সালান চাচা তুঘ্রিলের সাথে ফাতিমীদের বিরুদ্ধে দক্ষিণে প্রচার অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন এবং তার বাবা চাগিরি খোরাসানে ছিল। আল্প আর্সালান এর খোরাসানে ফিরে আসার পর তিনি তার বাবার পরামর্শে প্রশাসনের কাজ শুরু করেন। সেখানে থাকাকালীন তার পিত তাকে নিজাম-উল-মুলক এর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। যিনি প্রাথমিক মুসলিম ইতিহাসের অন্যতম বিশিষ্ট রাজনৈতিক এবং আল্প আর্সালান এর ভবিষৎ সহযোগী।
তার পিতার মৃত্যুর পর আল্প আর্সালান তার স্থালভিষিক্ত হন ১০৫৯ সালে খোরাসানের গভর্নর হিসেবে। আর্সালান এবং তার চাচা কুলতামিস উভয়ই এই উত্তরাধিকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন যা ১০৬৩ সালে দামঘনের যুদ্ধে সমাধান করা হয়। আর্সালান সিংহাসনের জন্য কুলতামিসকে পরাজিত করেন,এবং ২৭ এপ্রিল ১০৬৪ সালে সেলজুক সম্রাজ্যের সুলতান হিসাবে সফল হন এই ভাবে অক্সসাস নদী থেকে পারস্যের একমাত্রও রাজা হন।
তার সম্রাজ্যকে সুসংহত করতে এবং প্রতিদ্বন্দী গোষ্ঠীগুলোকে দমন করতে আল্প আর্সালানকে নিজাম -উল -মুলক অকুন্ঠ ভাবে সহায়তা করেছিলেন এবং তুঘ্রিল এর মৃত্যুর পর সাম্রাজ্যকে স্থিতিশীল করতে সাহায্য করার কৃতিত্ব দুইজনেরই। তার রাজত্বের মধ্যে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা হওয়ায় তার রাজ্যগুলিকে একটি সমাবেশে আহবান জানান এবং ১০৬৬ তিনি তার পুত্র মেলিক শাহ প্রথমকে উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেন। কাপাডোসিয়ার রাজধানী সিজারিয়া মাজকা দখলের আসায় তিনি নিজেকে তুর্কমেন অশ্বরোহীদের মাথায় রাখেন , উফ্রেটিস পার হন এবং শহরে প্রবেশ করেন এবং আক্রমণ করেন। নিজাম - উল - মুলকের সাথে তিনি আর্মেনিয়া এবং জর্জিয়াতে অগ্রসর হন , যা তিনি ১০৬৪ সালে জয় করেছিলেন। ২৫ দিন অবরোধের পর সেলজুকরা আর্মেনিয়ার রাজধানী আনি দখল করে নেয়। আনিতে গণহত্যের একটি বিবরণ দিয়েছেন ইতিহাসবিদ সিবত ইবনে আল - জাওজি যিনি একজন প্রতক্ষদর্শী উদৃত্তি দিয়ে বলেছেন :
" পারস্যের তরোয়ালকে তারা কাজে লাগিয়ে কাউকে ছার্ দেয়নি........কেউ সেখানে দেখতে পাচ্ছিলো মানুষের প্রতিটি যুগের দুঃখের বিপর্যয়। শিশুদের জন্য মায়ের আলিঙ্গন থেকে বিধস্ত ছিল এবং নির্দয়ভাবে পাথরের উপর নিক্ষেপ করা হয়েছিল , যখন মায়েরা তাদের কান্না এবং রক্তে ভিজিয়ে দিয়েছিলো .........শহরটি এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত ভরাট হয়েছিল নিহতদের মৃতদেহে। সেনাবাহিনি শহরে প্রবেশ করে তারা বাসিন্দাদের গণহত্যা করে লুন্ঠন করে এবং পুড়িয়ে দেয়, ধ্বংসস্তূপে ফলে ফেলে দেয় এবং যারা জীবিত ছিল তাদের সবাইকে বন্দি করে নিয়ে যায় মৃতদেহ এত বেশি ছিল যে কেউ তাদের উপর পা না দিয়ে কোথাও যেতে পারে না। বন্দিদের সংখ্যা ছিল ৫০০০০ এর কম ছিল না। আমি শহরে প্রবেশ করতে এবং নিজ চোখে ধ্বংস দেখতে প্রতিজ্ঞা ববধ ছিলাম। আমি এমন একটি রাস্তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি যেখানে আমাকে লাশের উপর দিয়ে হাটতে হবেনা কিন্তু সেটা অসম্ভব ছিল। "
বাইজেন্টাইন সংগ্রাম
১০৬৪ সালে সিরিয়ায় ফাতিমীদের সাথে লড়াইয়ের পর আল্প আর্সালান বাইজান্টাইন সম্রাজ্য আক্রমণ করেছিল। সম্রাট রোমানোস চতুর্থ ডায়োজেনিস ব্যাক্তিগত ভাবে কমান্ড গ্রহণ করেন , সিসিলিয়েতে আক্রমণকারীদের সাথে দেখা করেন। তিনটি কঠিন অভিযানে তুর্কিরা বিস্তারিতভাবে পরাজিত হয়েছিল এবং ১০৭০ সালে উফ্রেটিস জুড়ে চালিত হয়েছিল। প্রথম দুটি অভিযান সম্রাট নিজেই পরিচালনা করেছিলেন , এবং তৃতীয় সম্রাট ম্যানুয়েল কমেনেনসের বড় চাচা ম্যানুয়েল কমন্স দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। এই সময়ে আর্সালান আলেপ্পোর মির্দাসিত আমির রশিদ আল -দাওলা মাহমুদ এর অনুগত লাভ করেন।১০৭১ সালে রোমানোস আবার ক্ষেত্র গ্রহণ করে এবং আরমেনিয়া অগ্রসর হয় সম্ভবত ৩০,০০০ জন সেনার সাথে যার মধ্যে ছিল কুমান তুর্কিদের একটি দল এবং ফ্রাঙ্কস , নরম্যানদের দল উরসেল দে বাইউলের অধীনে। আল্প আর্সালান যিনি ফাতিমীদের সাথে লড়াই করার জন্য তার সন্যদের দক্ষিণে সরিয়ে নিয়েছিলেন , দ্রুত বাইজান্টাইনদের সাথে দেখা করার জন্য ফিরে গেলেন। মন্জিকার্টে মুরাত নদীর তীরে ভ্যান লেকের উত্তরে দুই বাহিনী মানজিকার্টের যুদ্ধ চালিয়েছিল। বাইজান্টাইন বাহিনীর মধ্যে কুমান ভাড়াটে সৈন্যরা তাৎক্ষনিকভাবে তুর্কিদের দিকে চলে যায়। এটা দেখে পরচিমা ভাড়াটে সৈন্যরা পালিয়ে যায় এবং যুদ্ধে অংশ নেয়নি। সুনিদ্দিষ্টভাবে বলতে গেলে রোমানোসকে সিজার (রোমানোসের সৎ পুত্র ) জেনারেল ঢুকাস দ্বারা বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছিল , যিনি তাকে মৃত ঘোষণা করেছিলেন এবং তার সাথে যাত্রা করেছিলেন বিপদজনক মুহূর্তে বাইজান্টাইন বাহিনীর একটি বড় অংশ বাইজান্টাইনরা সম্পূর্ণ ভাবে পরাজিত হয়েছিল।
সম্রাট রোমানোস চতুর্থ নিজেকে বন্দি করে আল্প আর্সলানের সামনে উপস্থিত করেন। একটি আনুষ্ঠানিক অপমানের পরে আর্সালান তার সাথে উদারতার সাথে ব্যবহার করেছিলেন। শান্তি শর্তে সম্মত হবার পর আর্সালান সম্রাটকে বরখাস্ত করেন , উপহার সহ এবং একটি সামরিক রক্ষী দ্বারা সম্মানজনক ভাবে উপস্থিত হন। সুলতানের সামনে রোমানসকে আনার পর নিম্ন লিখিত কথপোকথন ঘটেছে বলে জানা গেসে :
"আল্প আর্সালান : যদি আমাকে বন্দি হিসাবে আনা হয় তাহলে আপনি কি করবেন ?
রোমানোস : সম্ভাবত আমি তোমাকে হত্যা করতাম অথবা কনস্টান্টিপোল এর রাস্তায় প্রদর্শিত করতাম। আল্প আর্সালান : আমি তোমাকে এর থেকে বেশি শাস্তি প্রদান করসি , আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি , এবং মুক্তি দিয়েছি। "
আল্প আর্সলানের বিজয়ে সেলজুক তুর্কি ও সুন্নি মুসলমানদের পক্ষে পুরো এশিয়ার ভারসাম্য পরিবর্তন করেন। যদিও বাইজান্টাইন সম্রাজ্য আরো প্রায় ৪ শতাব্দী ধরে চলতে থাকে এবং ক্রুসেডরা কিসু সময়ের জন্য এই ইস্যুতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে মন্জিকার্টের বিজয় আনাতোলিয়া তুর্কম্যান আহরণের সূচনার ইঙ্গিত দেয়। মানজিকার্টের বিজয় তুর্কিদের মধ্যে এতো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে পরবর্তীতে আনাতোলিয়ার প্রতিটি সম্ভ্রান্ত পরিবার দাবি করতো যে তাদের একজন পূর্বপুরুষ ছিলো যারা সেদিন যুদ্ধ করেছিল।
রাষ্ট্রীয় সংগঠন
আল্প আর্সলানের শক্তিশালী সামরিক রাজ্য ছিল। অভ্যন্তরীন বিষয়গুলো পরিচলনা করতেন তার দক্ষ উজির নিজাম-উল -মুলক প্রশাসনিক সংগঠনের প্রতিষ্টাতা যিনি আল্প আর্সালান ও তার পুত্র মেলিক শাহ প্রথম এর শাসনআমলে সুলতানদের বৈশিষ্ট ও শক্তিশালী করেছেন। সেলজুক শাহ্জাদাদের দ্বারা পরিচালিত সামরিক জওয়ানরা সৈন্যদের সমর্থন প্রদান এবং যাযাবর তুর্কিদের প্রতিষ্ঠিত আনাতোলিয়ান কৃষি দৃশ স্থান দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই ধরণের সামরিক শাসন যাযাবর তুর্কিদের সেলজুক রাজ্যের অভ্যন্তরীণ পার্সিয়ান , তুর্কি এবং অন্যন প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতির সম্পদ টানতে সক্ষম করে এবং আল্প আর্সালানকে তার সৈন্যদের বেতন দেয়ার জন্য বিজয় থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন না করে একটি বিশাল সেনাবাহিনি দাঁড় করানোর অনুমতি দেয়। তার সামরিক বজায় রাখার জন্য তার প্রজাদের কাছ থেকে কেবল পর্যাপ্ত খাবারই ছিল না ব্যাবসায়ী এবং বণিকদের কাছ থেকে সংগৃহিত কর তার তহবিলের সাথে তার ক্রমাগত যুদ্ধের জন্য যথেষ্ট পরিমান যোগ করেছিল।
সোলাইমান ইবনে কুতালমিস ছিলেন আর্সলানের সিংহাসনের প্রতিদ্বন্দীর পুত্র তিনি উত্তর পরচিম অঞ্চলের গভর্নর নিযুক্ত হন এবং আনাতোলিয়ার আক্রমণ সম্পূর্ণ করার জন্য নিযুক্ত হন।